আমার খুব মনে পড়ছে সেই দিনটির কথা যেদিন আমি চিলির আতাকামা নগরীতে এক সন্ধ্যায় গাড়ি ও জনমানব বিহীন শূন্য রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছিলাম পাহাড়ের ভ্যালির কোনে থাকার জন্য- সেই আবাস স্থলের তাবুতে।
আতাকামা গ্লেসিয়ার ভ্যালিতে সন্ধ্যা নেমেছিল তখন। সূর্য অস্ত যাওয়ার পর আকাশের লালচে নরম আভা আর পাহাড়ের ভ্যালির গ্লেসিয়ার সবকিছু মিলে আমি অনুভব করেছিলাম এই রাজ্যে বুঝি আমি ছাড়া কেউ নেই। আমার সাথে থাকা ছোট্ট একটা ব্যাকপ্যাক, তার সাইড পকেটে একটা মাঝারি সাইজের পানির বোতল, জ্যাকেটের পকেটে ক্যামেরা আর সে দেশের কিছু মুদ্রা, বুকে সানগ্লাস ঝুলানো, গায়ে হালকা একটি জাকেট, মাথায় শক্ত করে বাঁধা স্কার্ফ যেন চুলগুলো প্রচণ্ড শুকনো তাপমাত্রায় খাড়া হয়ে বের না হয়ে যায়। এভাবেই আমার নয় দিনের আতাকামা সফরে আমি প্রতিদিন সন্ধ্যায় এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে হেঁটে বেড়াতাম এমন ঐশ্বর্যময় পাহাড়ের ভ্যালির কোলে কোলে।
প্রকৃতির দুই রকম তাপমাত্রা আতাকামা নগরীতে অদ্ভুত রূপ ধারণ করে। দিনের বেলায় প্রচণ্ড গরম সূর্যের কঠোর তাপমাত্রার দাবাদহে পুড়ে যাওয়ার মত অবস্থা হয়, আবার সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় কেঁপে ওঠা শরীর হয়তো একটু আগুন জ্বালিয়ে কিংবা ভারী কোনো পোশাক পরে বেঁচে থাকে মানুষ সেখানে। তাদের নেই কোন আধুনিকতার ছোঁয়ায় নিজেদের আবাসস্থল গরম রাখার কোনো ব্যবস্থা। জঙ্গল থেকে কুড়িয়ে আনা কাঠের টুকরো দিয়ে তারা অনেকেই আগুন জ্বালিয়ে শীতার্ত রাতের ঠাণ্ডা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখে।
চাঁদের ভ্যালি দেখার জন্য এই নগরীতে এসে প্রথম নেমেছিলাম। ১০০ বছরেও বৃষ্টি পড়েনি মাটিতে। এখানকার স্বল্প সংখ্যক মানুষের জীবন চলমান শুধু পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আসা পরিব্রাজকদের নিয়ে। কেউ ট্যুর গাইড, হয়তো কারো সুভেনিয়রের দোকান আছে কিংবা কেউ হয়তো কোন রেস্টুরেন্টের মালিক এখান থেকেই তাদের জীবন পরিচালনার একমাত্র উপার্জন।
কিন্তু সেই আতাকামার মানুষের ভিন্ন সভ্যতার মাঝে খুঁজে পাওয়া যাবে চন্দ্র ভ্যালির অপূর্ব সুখের আভাস। চারিদিকে তাকালেই দেখা যাবে লালছে মাটির নিপুন হাতে গড়া ছোট ছোট ঘর। হাহাকার, কোলাহল কিংবা তাদের মাঝে নেই কোন অধিক পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা। সাদাসিধা জীবনের মাঝে বেঁচে থাকা এই আতাকামা নগরী আমাকে সত্যি আকৃষ্ট করেছে।
এখানে চুল খোলা রেখে হাঁটলেই গাছ গাছালির পাতার মতোই বাতাসের শুষ্কতার জন্য চুল গুলো খাড়া হয়ে যায়। কখনো প্রচণ্ড শুষ্ক তাপমাত্রা জন্য আমার শরীরের চামড়া ফেটে রক্তকণিকা বেরিয়েছি, কখনো লক্ষ্য করতাম শরীর যেন টানটান হয়ে থাকতো।
তারপরও আমি সকল প্রাকৃতিক বৈরী তাপমাত্রাকে উপেক্ষা করে কোন অপূর্ব নির্জন নগরীর এমন সুরেলা বিকেল কিংবা সূর্যোদয়ের ভোর দেখার জন্য অপেক্ষা করতাম। আমি জানি হয়তো কোনদিন পৃথিবীর ওই দেশের ওই নগরীর রাস্তায় আমার হয়তো আর হাঁটা হবে না। তাই মাঝে মাঝে পৃথিবীতে এমন কিছু শূন্য রাস্তা দেখলেই আমি একা একা হেঁটে বেড়াই।
দক্ষিণ আমেরিকার এক দেশ থেকে আরেক দেশে সড়ক পথে আমার দীর্ঘ জার্নি, শুকনো-আদ্র তাপমাত্রায় ঘুরে বেড়ানো এক কঠিন জীবন, আমার চোখে মুখে কালো কালো দাগের চিহ্ন আমাকে একজন বিবর্ণ তামাটে মানুষ বানিয়েছে প্রকৃতি। আমি যখন যেখানে গিয়েছিলাম তখন প্রকৃতি আমাকে তাদের মতো করে বাঁচার জন্য রূপায়িত করেছে।
যখনই আমি ঘুরতে ঘুরতে এভাবে বিবর্ণ হয়ে যেতাম তখন মাঝে মাঝে আয়নার সামনে দাঁড়ালে আমি আমার নিজেকে চিনতে পারতাম না। আমি তখন এক ভিন্ন পৃথিবী মানবী। আমার শরীর মন তখন পৃথিবীর সাথে মিশে একাকার। পৃথিবীর ধুলো বালির সোঁদা গন্ধ, প্রকৃতির গাছ-গাছালি আর ভিন্ন দেশের সূর্য প্রবাহ মেখে আমি যখন ঘরে ফিরি- তখনও আমার মন পড়ে থাকে পৃথিবীর পথে প্রান্তরে। আর চোখ বন্ধ করলেই চোখের কোনে ভেসে আসে সেই শান্ত নির্জন কোন এক ছোট্ট নগরীর কোলাহলবিহীন জীবন।
অচেনা শহরে অচেনা নগরীতে এভাবে কত যে নির্ভয়ে হেঁটে বেড়িয়েছি শুধু জীবনের এই অমূল্য মুহূর্তগুলোকে ধারণ করে নিয়ে আসার জন্য। হয়তো সেই নগরীতে আমার আর কোনদিন ফেরা হবে না। সেই পথ ধরে হয়তো আর হাঁটা হবে না, কারণ আমি যে বারবারই খুঁজে বেড়াই পৃথিবীর নতুন কোন পথ।
লেখক : বাংলাদেশের পতাকাবাহী প্রথম বিশ্বজয়ী পরিব্রাজক